Economy

ফিফা কিভাবে অর্থ উপার্জন করে?

Written by: সুরাইয়া জামান

28-02-2024

ফিফা কিভাবে অর্থ উপার্জন করে?


জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিশ্বব্যাপী আয়োজিত আন্তর্জাতিক খেলাগুলোর মধ্যে ফুটবল হচ্ছে অন্যতম জনপ্রিয় এবং শীর্ষস্থানীয় খেলা। বিশ্বের প্রায় ২১৫ টির বেশি দেশে বর্তমানে অফিসিয়ালি ফুটবল খেলা হয়। তবে ফুটবল খেলা দেশের সংখ্যা যেমনই হোক না কেনো, দর্শক হিসেবে ফুটবলপ্রেমীর সংখ্যা কিন্তু অগণিত। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন বড় স্ক্রিনের সামনে উপচে পড়া ভীড় থেকে শুরু করে পাড়ার ফুটবল ক্লাব, সবখানে এই খেলার জয়জয়কার দেখে এই খেলার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা যায়। এজন্য এই খেলাকে The Greatest Show of The Earth হিসেবেও আখ্যা দেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা।


ফুটবল শব্দটা মুখে আনলে এর সাথে ফিফা নামটাও চলে আসে। ফিফা হচ্ছে এমন একটি সংস্থা যা বিশ্বব্যাপী ফুটবলের এতো জনপ্রিয়তা লাভের পেছনে ১৯০৪ সাল থেকে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। এই খেলার উন্নয়ন, খেলার রীতি-নীতি, ৪ বছর অন্তর বিশ্বকাপ সহ বিভিন্ন বড় আয়োজন গুলোর তত্ত্বাবধায়ন করা, সর্বোপরি ফুটবলের অখন্ডতা রক্ষা করার মাধ্যমে এর জনপ্রিয়তা ধরে রাখাই মূলত ফিফার কাজ। কিন্তু অলাভজনক সংস্থা হিসেবে ফিফা এতো কিছু সামাল দেয় কিভাবে? শতবছর ধরে চলমান ফিফার আদতে আয়ের উৎস কি? ফিফা কিভাবে এবং কত অর্থ উপার্জন করে তা আজ জানার চেষ্টা করবো এই লেখার মাধ্যমে।

ফিফার মতো অলাভজনক আরেকটি ক্রীড়া সংস্থা হচ্ছে ICC। ICC কিভাবে ব্যবসা করে থাকে তা পড়তে পারেন এই লিংকে- ICC কিভাবে ব্যবসা করে?


ফিফার আয়ের ক্ষেত্র

২০১৮ সালের বিশ্বকাপ থেকে ফিফা মোট ৪.৬ বিলিয়ন ডলার ইনকাম করেছে। ২০২২ এর বিশ্বকাপে অর্থাৎ মাত্র ৪ বছর পরই ফিফা বানিজ্যিকভাবে আয় করেছে ৭.৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগেরবারের তুলনায় অন্তত ১০০ কোটি ডলার বেশি। এতো গেল আয়ের কথা। এর আগেই ফিফা কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে ২০২২ এর বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলো সব মিলিয়ে ৪৪০ মিলিয়ন বা ৪৪ কোটি ডলার পুরস্কার পাবে। এতো একেবারে মুখের কথা নয়! কিভাবে এবং কিসের ভিত্তিতে এতো বড় পুরষ্কার ঘোষণা করেছিলো ফিফা?

ফিফা মূলত ৪টি বড় উৎস থেকে অর্থ উপার্জন করে থাকে। এগুলো হচ্ছেঃ 


* টিভি স্ট্রিমিং রাইটস


* মার্কেটিং রাইটস


* টিকিট সেলিং এবং হসপিটালিটি রাইটস

* ব্র্যান্ডিং এবং লাইসেন্সিং রাইটস



টিভি স্ট্রিমিং রাইটস

ফিফার মোট আয়ের বেশিরভাগই আসে বিশ্বকাপ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টের জন্য টিভি সম্প্রচার স্বত্ত্ব বিক্রি করা বা টিভি স্ট্রিমিং রাইটস থেকে। যেহেতু ফুটবল আন্তর্জাতিক মানের খেলা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এই খেলা উপভোগ করে থাকে, তাই সবার কাছে ফিফা আয়োজিত বিভিন্ন টুর্নামেন্টের উন্মাদনা পৌঁছে দিতে নামী-দামী টিভি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ফিফার কাছ থেকে স্ট্রিমিং রাইটস কিনে থাকে। বিভিন্ন খেলা বিশেষ করে ফুটবলের বিভিন্ন টুর্নামেন্ট সরাসরি সম্প্রচারের জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ব্যয় করে থাকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।

পরিসংখ্যান মতে, বিগত ৮ বছরে ফিফার মোট আয়ের ৭০ শতাংশই এসেছে সম্প্রচারকারী টিভি প্রতিষ্ঠান থেকে। ২০২২ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ফিফা প্রায় ৭.৫ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছে, যার ৬৫ শতাংশই এসেছে টিভি স্ট্রিমিং থেকে!

মূলত পরের বিশ্বকাপে আয়ের টার্গেট ফিফা আগের ৪ অর্থবছরের শুরুতেই করে থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স ও কাতারের বিইআইএন স্পোর্টসের কাছে ফিফা টিভি স্ট্রিমিং রাইটস বিক্রি করেছিলো অনেক আগেই। 


মার্কেটিং রাইটস

ফিফা ইতোমধ্যে বিশ্বের কাছে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এক বিশাল মার্কেটিং জায়ান্ট হিসেবে। বিশেষ করে বিশ্বকাপের সময় ফিফার জায়ান্ট মার্কেটিং স্ট্রাটেজি সম্পর্কে বিশদ ধারনা পাওয়া যায়। গড়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন দর্শক বিশ্বকাপের প্রতিটি টুর্নামেন্ট উপভোগ করলে, শুধুমাত্র  মার্কেটিং রাইটস বিক্রি করে কি পরিমাণ আয় করা সম্ভব তা একটু অংক কষলেই ধারনা পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলি ফিফার ডেভেলপমেন্ট ও সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি ফান্ডের পার্টনার হয়ে থাকে। গত বিশ্বকাপ থেকে ফিফা যা আয় করেছে তার মোট ২৯ শতাংশ এসেছে মার্কেটিং রাইটস থেকে। অবশ্য ফিফার টার্গেট ছিলো, মার্কেটিং রাইটস থেকে ২০২২ এর বিশ্বকাপে অন্তত ১৩৫ কোটি ডলার ইনকাম করার। এই বিশ্বকাপে শীর্ষ পর্যায়ের স্পন্সর এবং পার্টনার হয়েছিলো কাতার এনার্জি, ভিভো, কোকাকোলা, এডিডাস, কাতার এয়ারওয়েজ এবং ভিসা। এ ছাড়া কাতারি ব্যাংক কিউএনবি এবং টেলিকমিউনিকেশন ফার্ম ওরেডুর মতো তৃতীয় সারির স্পন্সরদের সঙ্গেও চুক্তি করেছে ফিফা। 


টিকিট সেলিং এবং হসপিটালিটি রাইটস

ফিফার মোট আয়ের প্রায় ১০ শতাংশ আসে এর টিকেট বিক্রির আয় থেকে। ফুটবল খেলা মাঠে বসে উপভোগ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে ফুটবল প্রেমীরা, গ্যালারী ভর্তি দর্শকের মাঝে বসে নিজের পছন্দের দলটিকে সাপোর্ট করতে। এতো বড় আয়োজনের অংশ হতে হলে টিকেটেও খরচ করতে হয় মোটা অংকের অর্থ। তবে সর্বশেষ বিশ্বকাপে দর্শকদের টিকেট কিনতে হয়েছিলো সর্বকালের সর্বোচ্চ অর্থ খরচে। এতো দামী টিকেট কেটে আগে কখনো বিশ্বকাপের খেলা দেখতে হয়নি ফুটবলপ্রেমীদের। একটি জার্মান সংস্থার মতে, কাতার বিশ্বকাপে টিকিটের দাম ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপের তুলনায় ছিল ৪০ শতাংশ বেশি। 

শুধুমাত্র টিকিট বিক্রি বাবদ ফিফা এই বিশ্বকাপে কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডলার অর্থ উপার্জন করেছে। কাতারে ফাইনাল ম্যাচে টিকিটের দাম পৌঁছেছিল ৬৮৪ পাউন্ড। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৮৭ হাজার টাকারও বেশি।

ফলে, গোটা টুনার্মেন্টে প্রতিটি আসনের জন্য গড়ে ২৮৬ পাউন্ড দামে ৩০ লাখের বেশি টিকিট বিক্রি হয়েছে ধরলে এই খাত থেকে ফিফার আয় হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার!

এছাড়াও আতিথেয়তা এবং আবাসিক থাকার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ফিফা মোটা অংকের টাকা আয় করে থাকে। 


ব্র্যান্ডিং এবং লাইসেন্সিং রাইটস

বলাই বাহুল্য যে, ফিফা বর্তমান বিশ্বের একটি ব্র্যান্ড। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন স্পোর্টস প্রতিষ্ঠানে ফিফা এবং তার লোগো ব্যবহারের জন্য ফিফা নিজস্ব ব্র্যান্ডিং রাইটস বিক্রি করে থাকে। এছাড়াও ফিফার অনুমোদিত বিভিন্ন পণ্য বিক্রি, রয়্যালটি পেমেন্ট এবং এই ধরনের আরো একাধিক খাত থেকে অর্থ আয় করে থাকে সংস্থাটি। উদাহরন হিসেবে বলতে গেলে ইলেকট্রনিক আর্টস সিরিজ এর নাম আসে সবার আগে। এর সঙ্গে ফিফার ২০ বছরের পার্টনারশিপ রয়েছে। প্রতি বছর এই গেমস প্রস্তুতকারক সংস্থা ফিফাকে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে থাকে। এভাবেই নাম এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু ব্যবহার করে ফিফা প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ উপার্জন করে আসছে। 


পরিশিষ্ট

ফুটবলের মতো নান্দনিক একটি খেলার বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে ফিফা। শুধুমাত্র গোছানো ব্যবসায়িক প্ল্যান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবার কারণে শতবর্ষী ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থাটি দিন দিন আরো সমৃদ্ধ হচ্ছে। কাতার বিশ্বকাপ শেষ হতে না হতেই পরের বিশ্বকাপে নজর দিয়েছে ফিফা। পরের বিশ্বকাপ যেহেতু আয়োজিত হবে আমেরিকা, মেক্সিকো ও কানাডাতে তাই তিন দেশ মিলে এমনিতেই কাতার বিশ্বকাপের চেয়ে ব্যয় বাড়বে বহুগুণে। লাভের মাত্রা অটুট রাখতে তাই বিভিন্ন পরিকল্পনা করে চলেছে ফিফা। ঠিক করে নিয়েছে লাভের লক্ষ্যমাত্রাও! তবে উপার্জনের মাত্রা যে গতিতেই আগাক না কেনো, আসন্ন বিশ্বকাপ নিয়ে ফুটবল প্রেমীর উন্মাদনার ঢেউ কিন্তু ঠিকই আছড়ে পড়বে স্টেডিয়াম জুড়ে কিংবা মাঠের বড় স্ক্রিনে। 


তথ্যসূত্রঃ

The Business Standard
Statista

Previous Post

Next Post

Related Posts

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

28-08-2024

Economy

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

গত বেশ কয়েক বছরে বাংলাদেশের ফরেইন রিজার্ভ নিয়ে...

Read More
মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল

23-05-2024

Economy

মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল

বাংলাদেশের জনজীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ যেন এখন...

Read More
ঈদের অর্থনীতিঃ বাংলাদেশের যত ব্যবসা ঈদে

09-04-2024

Economy

ঈদের অর্থনীতিঃ বাংলাদেশের যত ব্যবসা ঈদে

পবিত্র রমজান মাস জুড়ে রোজা পালনের মাধ্যমে দেহের...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter