Economy

প্রাণ-আরএফএল যেভাবে দেশে বিদেশে সফল হল

Written by: Suraiya Zaman

19-11-2023

প্রাণ-আরএফএল যেভাবে দেশে বিদেশে সফল হল

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পরের কথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখ করার মতো একমাত্র শিল্প হিসেবে টিকে ছিলো পাটশিল্প। কৃষি পর্যায়ে তখন চরম দূর্দশা। আধুনিক যন্ত্রপাতি কিংবা ভালো সেচযন্ত্র নেই। ভালো বীজ, পর্যাপ্ত সার সবকিছুর অভাবে কৃষিনির্ভর এই দেশের গ্রাম পর্যায়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। খাবার তা যাই হোক ভালো-মন্দ জুটে যেতো কিন্তু পানি! নিরাপদ এবং বিশুদ্ধ পানির উৎসের অভাবে নদীর উপরেই নির্ভর ছিলো গ্রামের দরিদ্র মানুষ। যুদ্ধের পর আস্তে আস্তে চারিদিকে থমকে থাকা ব্যবসা বানিজ্যগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকলে দূষণের কারনে সেই নদীর পানিও হয়ে উঠতে থাকে খাবার অযোগ্য। বিশুদ্ধ পানির অভাবে সেই সময়ে মানুষের, বিশেষ করে বাচ্চাদের পানিবাহিত নানা রোগ লেগেই থাকতো। গ্রামে গ্রামে সরকারীভাবে একটি বা সর্বোচ্চ দুটি টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করে দিতো সরকার। একমাত্র পানির উৎস হিসেবে সেগুলো ব্যবহৃত হতে শুরু হলেও মানুষের দূর্ভোগ কিন্তু রয়েই গেলো! 

 

স্বাধীনতার পরের দশকের শুরুতে, মেজর জেনারল আমজাদ খান চৌধুরী চাকরী থেকে অবসর নেন। অবসরের পর অলস জীবন কাটাতে না চেয়ে নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে নতুন ব্যবসা শুরুর কথা চিন্তা করেন নাটোরের এই কৃতি সন্তান। তার এই ইচ্ছা থেকেই জন্ম নেয় আজকের এই বিশাল বহুজাগতিক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে সহজলভ্যে টিউবওয়েল এবং চাষিদের পাশে সার্বিকভাবে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে শুরু করা এই যাত্রা এরপর আর থেমে থাকেনি বরং তা দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। 

 

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সৃষ্টি ও কাজের ধারা

যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর রংপুরে কর্মরত ছিলেন সাবেক আর্মি জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরী। রংপুর তথা সারা উত্তরবঙ্গের মানুষের অভাব তিনি নিজ চোখে দেখে অনুভব করেছিলেন। মানুষের দারিদ্র দূর করতে চেয়েছিলেন তিনি, চেয়েছিলেন দেশের কৃষিকে শিল্পে রূপান্তর করতে। অবসরের পর তাই রংপুরেই নিজের প্রথম ব্যবসাটি শুরু করে নাম দিয়েছিলেন রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড সংক্ষেপে আরএফএল। 

 

সুপেয় পানির জন্য উত্তরবঙ্গে মানুষের হাহাকার মেটাতে টিউবওয়েল এবং কৃষিকাজের সুবিধার জন্য সুলভ মূল্যে কৃষিজ যন্ত্রপাতি তৈরির মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো আরএফএল এর যাত্রা। 

ছবিঃ ‘প্রাণ-আরএফএল’ গ্রুপের প্রাণ মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী

 

যেহেতু কৃষকদের জন্য আমজাদ খান চৌধুরী কিছু করতে চেয়েছিলেন তাই তিনি ফাউন্ড্রি ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকেন্দ্রিক ব্যবসা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে নরসিংদীতে স্বল্প পরিসরে কলা, পেঁপে, আনারস, রজনীগন্ধা ইত্যাদি চাষ করা শুরু করে এই গ্রুপ। একটা পর্যায়ে তিনি দেখলেন, এ দেশের কৃষিকাজের অন্যতম সমস্যা হলো মৌসুমের সময় ভালো ফসল উৎপাদন হলেও কৃষকরা ন্যায্য দাম পান না। তিনি অনুধাবন করলেন যে, কৃষককে রক্ষা করতে শুধু ফসল উৎপাদন করলেই হবে না, গুরুত্ব দিতে হবে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপরে, যাতে পণ্যের সেল্ফ লাইফ বাড়ে, পরিবহন সহজ হয়। এরপর তিনি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে মনোনিবেশ করেন। এভাবেই অ্যাগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড, তথা প্রাণের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে একই ধারায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে মানুষের দৈনন্দিন খাবারের তালিকা থেকে খাবার টেবিলের মালিকানাও দখল করে রেখেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। 

একইভাবে ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে জন্ম নেওয়া ব্র্যাক কিভাবে মহীরুহ হয়ে উঠেছে পড়তে পারেন। 

 

 

 

বর্তমান অবস্থা

বিশ্বের ১৪৫টি দেশে এখন রপ্তানী হয় প্রাণের পণ্য। বলা যায়, খাদ্যশিল্পে প্রাণ বর্তমানে  বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে বিশ্বের দরবারে। একইভাবে আরএফএল এর প্লাষ্টিক এবং উন্নত ফার্নিচার পণ্যে ছেয়ে গেছে যেনো গোটা দেশ। পাশাপাশি বিদেশেও বছরের পর বছর মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরনে সক্ষম হয়েছে এই গ্রুপ। রপ্তানিতে বিশেষ অবদান রাখায় প্রাণ- আরএফএল গ্রুপ সরকারের কাছে পরপর ১৬ বার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি পেয়েছে।

 

ছবিঃ ২০২০-২০২১ সালে ৫ টি রপ্তানী ট্রফি পেয়েছিল প্রাণ-আরএফএল



কানাডায় ওয়ালমার্ট, সৌদি আরব ও ওমানে ক্যারিফোর, যুক্তরাজ্যে পাউন্ডল্যান্ড, ভারতে রিলায়েন্স ফ্রেশ ও সিটি মার্ট, কাতারে গ্র্যান্ড মল ও আনসার গ্যালারি, সিঙ্গাপুরে জায়ান্ট ও শিং শিয়ং এবং মালয়েশিয়ায় টেসকো, এইওন ও সেগি ফ্রেশের সুপারশপে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে সগৌরবে জায়গা করে নেওয়া প্রাণ বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার চাহিদার কথা মাথায় রেখে পণ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য ও পানীয়, প্লাস্টিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস, ফার্নিচার, বাইসাইকেল, লিফট, টেক্সটাইল, টয়লেট্রিজ, প্যাকেজিং শিল্পে প্রায় ৫৭ হাজার পণ্য রয়েছে এই গ্রুপের। দেশের ১৩টি স্থানে ২৩টি কারখানা রয়েছে প্রাণ-আরএফএলের।

দারিদ্র্য দূর করা এই করপোরেট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলা এই গ্রুপের রয়েছে কিছু সাম্যের নীতি। এখানে বর্তমানে ১,১৫,০০০ কর্মীর সবার পোষাক একই রকমের, আকাশি রঙের শার্ট। ছোট কিংবা বড় ভেদাভেদ না রাখার জন্যই এই পন্থা। খাবারের ব্যবস্থাও সবার জন্য উন্মুক্ত। এছাড়াও কর্মীদের জন্য রয়েছে আলাদা ওভারটাইমের ব্যবস্থা। 

বর্তমানে প্রাণের সাথে কাজ করছে প্রায় লক্ষাধিক কৃষক। তারা তাদের উৎপাদিত ফসল যেমন মরিচ, টমেটো, গম, হলুদ, আম কিংবা দুধ সরাসরি এই গ্রুপের কাছে বিক্রি করে থাকে এবং প্রাণ তা নিজস্ব খরচে সংগ্রহ করে কারখানায় নিয়ে তা প্রক্রিয়াজাত করে থাকে। 

সম্প্রতি দেশে প্রথম হেলমেট উৎপাদনে নেমেছে প্রাণ-আরএফএল। প্রথমবারের মতো তাদের তৈরি "সেফমেট" হেলমেটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি অ্যাডভান্সড এবিএস শেল ও পিসি ম্যাটেরিয়ালে তৈরি। হয়তো এই খাতেও তারা খুব অল্প সময়েই আকাশ্চুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করবে বাইকারদের কাছে। 

আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুর পর বর্তমানে এই গ্রুপে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার সুযোগ্য ছেলে আহসান খান চৌধুরী। তার অন্যান্য সন্তানেরাও এই গ্রুপের সাথে পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত আছেন। 

 

গ্রোথ স্ট্রাটেজি

যেকোনো ব্যবসায় সফল হতে হলে ক্রেতার প্রয়োজন বোঝাটা সবচেয়ে জরুরী। ব্যবসায়ের প্রাণ হচ্ছে কর্মীরা, তাদের সাথে ভালো বোঝাপড়াই পারে যেকোনো ব্যবসায় অন্য মাত্রা যোগ করতে।

প্রাণ-আরএফএল ঠিক এই স্ট্রাটেজিতেই এগিয়ে গেছে। তারা প্রথমে মানসম্মত প্লাষ্টিকের ব্যবহার্য পণ্য উৎপাদন করে গৃহিনীদের রান্নাঘরে পৌঁছে তাদের আস্থা যুগিয়েছে। এরপর সময়ের সাথে উপযোগী নানান পণ্যে নজর দিয়েছে তারা। বাচ্চাদের পড়ার টেবিল থেকে শুরু করে ওয়্যারড্রব সবকিছু নিয়ে ভেবেছে তারা। ফলে একেরপর এক ফার্নিচার সামগ্রী অল্প খরচে বাজারজাত করতে এবং বিশাল নেটওয়ার্কিং তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। 

অন্যদিকে, কর্মীদের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরনে তাদের নেওয়া প্রত্যেকটি পদক্ষেপ প্রশংসার দাবীদার। টিম ওয়ার্ক, ক্রেতা সন্তুষ্টি ও কর্মীদের সন্তুষ্টিকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে এসেছে এই গ্রুপ। 

ভালোমানের পণ্য বাজারে আনতে কখনো আপোষ না করা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ জানতো, সব ক্ষেত্রে টোটাল কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস কতটা জরুরী। তাইতো বাজারে তাদের নতুন পণ্যের জনপ্রিয়তা পেতে কোনো অসুবিধা হয় না।

প্রাণের পণ্যের ক্ষেত্রেও খাদ্যের গুণগত মান, প্যাকেজিং, নতুন পণ্য বাজারে আনার ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিয়ত চেষ্টা লক্ষনীয়। 

দেশের এমন কোনও গ্রাম নেই, যেখানে প্রাণ-আরএফএল এর পণ্য নেই। সৃষ্টিশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আমজাদ খান চৌধুরী এবং পরবর্তীতে তার সন্তানেরা বাংলাদেশের শিল্পে নতুন নতুন পণ্য যোগ করে প্রমাণ করেছে শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সম্ভব।

 

Previous Post

Next Post

Related Posts

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

28-08-2024

Economy

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

গত বেশ কয়েক বছরে বাংলাদেশের ফরেইন রিজার্ভ নিয়ে...

Read More
মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল

23-05-2024

Economy

মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল

বাংলাদেশের জনজীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ যেন এখন...

Read More
ঈদের অর্থনীতিঃ বাংলাদেশের যত ব্যবসা ঈদে

09-04-2024

Economy

ঈদের অর্থনীতিঃ বাংলাদেশের যত ব্যবসা ঈদে

পবিত্র রমজান মাস জুড়ে রোজা পালনের মাধ্যমে দেহের...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter