Miscellaneous

বিশ্বের সেরা কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের কাজ

Written by: এস এম নাহিয়ান

12-09-2024

বিশ্বের সেরা কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের কাজ


বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা সংস্থা কোনটি, সে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। রয়েছে অনেক যুক্তি, পাল্টা-যুক্তি। কিন্তু এত যুক্তি-তর্কের ভেতর না গিয়ে সেরা কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা করাটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। আজকের লেখাতে তেমনই কিছু গোয়েন্দা সংস্থার কাজের ধরন, প্রধান অপারেশন, এবং তাদের উল্লেখযোগ্য নানা অপারেশন সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে। এই তালিকায় থাকা প্রতিটি সংস্থাই সেরাদের কাতারে পড়ে বইকি।

১। সিআইএ (CIA) 

রাজনৈতিক আলাপ করেছেন কিন্তু সিআইএ এর নাম শোনেন নি, এমন ব্যক্তি খুব কম আছেন বাংলাদেশে। কিন্তু নাম শুনলেও অনেকেরই এ সংস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা নেই। তাই এক ঝলকে জেনে নেওয়া যাক কিছু তথ্য।


পূর্ণ নাম 

সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি (Central Intelligence Agency - CIA)

স্থাপত্যকাল 

সেপ্টেম্বর ১৮, ১৯৪৭

প্রধান কার্যালয় 

ল্যাংলি, ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র 

মটো 

"The Work of a Nation. The Center of Intelligence."


ইতিহাস 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের পরেই বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ। নতুন পরিস্থিতির সাথে তাল মেলাতে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন ভুল থেকে শিক্ষা নিতে আমেরিকা একটি নতুন গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন অনুভব করে। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালে আমেরিকান ‘অফিস অফ স্ট্রাটেজিক সার্ভিসেস (Office of Strategic Services) কে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক অফ ১৯৪৭ (National Security Act of 1947) এর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে সিআইএ। 


চিত্রঃ সিআইএ এর লগো 

গঠনতন্ত্র 

সিআইএ মূলত কাজ করে ‘ডিরেক্টর অফ ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স (Director of National Intelligence -DNI)’ এর অধীনে। সিআইএ এর ডিরেক্টর নিয়োগ পান সরাসরি রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। তবে তাতে সিনেট সদস্যদের অনুমোদন লাগে। ডিরেক্টরের অধীনে ছয়টি বিভাগে সিআইএ কাজ করে। 


বিশেষত্ব 

প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থাই স্পাই, ইনফর্মেন্ট, এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া সহ আরও নানা ধরনের কাজ করে থাকে। তবে সেরাদের কাতারে থাকা এসকল গোয়েন্দা সংস্থার কিছু দিক সেরাদের থেকেও সেরা। 


সিআইএ এর প্রথম বিশেষত্ব এর গোপনীয়তা। এটি প্রত্যেকটি গোয়েন্দা সংস্থার জন্যই অবিচ্ছেদ্য একটি বিষয়। কিন্তু বিভিন্ন হাত ঘুরে এবং বিভিন্ন পথে সিআইএ অনেক কাজ এমন ভাবে করিয়ে নিতে সক্ষম, যাতে যে করছে সে নিজেও বুঝতে না পারে যে কার হয়ে কাজ করছে। এর বাইরেও জঙ্গি সংক্রান্ত কার্যক্রমে বিশেষ পটু হওয়ায় তাদের সুনাম ও দুর্নাম দুটোই আছে। এসব ছাড়াও সিআইএ এর সাইবার এসপিওনেজকে বলা হয় বিশ্বসেরা। 

প্রধান অপারেশনসমূহ 

১। অপারেশন অ্যাজাক্স

সিআইএ জন্মানোর কিছু বছর পরেই সংস্থাটি ভূমিকা রাখে একটি দেশের সরকার পতনের পেছনে। ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দগ কে সরিয়ে আবারও ক্ষমতায় বসায় রেজা শাহ পাহলভী কে। 

২। অপারেশন সাইক্লোন

তালিবানদের সাথে আমেরিকার দীর্ঘ সংঘাতের কারণে অনেকেই হয়তো বিষয়টি ভুলে গেছেন। কিন্তু ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯, দীর্ঘ ১০ বছর সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তালেবানদের বিপুল সহায়তা করে আমেরিকান সিআইএ। 

৩। অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার

২০১১ সালে সিআইএ এর হাতে পাকিস্তানে নিহত হন আল-কায়েদার প্রধান, ওসামা বিন লাদেন। এ ব্যাপারে সিআইএ পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। 


২। এমআইসিক্স 

দ্যা ফাদার অফ অল সিক্রেট সার্ভিসেস - এমআইসিক্স। বিশ্বের প্রথম স্বতন্ত্র গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস ব্যুরো বা এসআইএস (SIS)। জানা যাক এর সম্পর্কে কিছু তথ্য। 


পূর্ণ নাম 

সিক্রেট ইন্টিলিজেন্স সার্ভিস (Secret Intelligence Service - SIS)। মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স সিক্স নামে পরিচিত। 

স্থাপত্যকাল 

১৯০৯

প্রধান কার্যালয় 

ভক্সল ক্রস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য 

মটো 

"Semper Occultus" (Always Secret)


ইতিহাস 

১৯০৯ সালে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৯৪ সাল অবধি এর অস্তিত্ব জনসম্মুখে স্বীকার করে নি ব্রিটিশ সরকার। এমনকি ‘এমআইসিক্স’ নামটির সাথেও জড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস অনেক নামেই পরিচিত ছিল। সে সময় অন্য গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর মধ্যে এটি পরিচিত ছিল ‘মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স সেকশন সিক্স’ নামে। সেখান থেকেই এমআইসিক্স। বর্তমানে এটি সে নামেই অধিক পরিচিত। 

চিত্রঃ ব্রিটিশ সিক্রেট ইন্টিলিজেন্স সার্ভিস এর সদর দপ্তর 

গঠনতন্ত্র 

এমআইসিক্স এর প্রধানকে বলা হয় ‘চিফ’। এমনকি শুধু ‘সি’ ( C ) নামেও পরিচিত হয়ে থাকেন তিনি। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করলেও সংস্থাটি সরাসরি রিপোর্ট করে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে। সিআইএ এর মতো এটিও অপারেশনস, ইন্টিলিজেন্স, কাউন্টার টেরোরিসম, ইত্যাদি বিভাগে বিভক্ত। 

বিশেষত্ব 

এসপিওনাজ এর ক্ষেত্রে এমআইসিক্স কে অনেক ক্ষেত্রেই সেরাদের সেরা ধরা হয়। বিশেষত অতি ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারের ভেতরে নিজেদের লোক বসাতে পারাটা এমআইসিক্স এর বিশেষ পারদর্শীতা।

এছাড়াও তাদের আরেকটি বিশেষত্ব হলো অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে তাদের সংযোগ। প্রথম স্বতন্ত্রগোয়েন্দা সংস্থা হওয়ার সুবাদে বিশ্বের প্রথম সারির অনেক সংস্থাই এক সময়ে তাদের থেকে সাহায্য বা পরামর্শ নিয়েছে। তার ভেতর সবচেয়ে বড় নাম, সিআইএ! তাই দ্বৈতবাহিনীর অপারেশনের ক্ষেত্রে এমআইসিক্স বরাবরই এগিয়ে। 

প্রধান অপারেশনসমূহ 

১। ক্র্যাকিং এনিগমা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এমআইসিক্স, ব্রিটিশ কোড অ্যান্ড সাইফার স্কুল অন্যান্য বেসামরিক বিশেষজ্ঞের সহায়তায় এসপিওনাজের জগতে যুগান্তকারী এক ঘটনা ঘটায়। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে জার্মানদের এনক্রিপশন মেশিন এনিগমার কোড ভাঙ্গতে সক্ষম হয় ব্রিটেন। কিন্তু এই সাফল্যের কথা কোনোভাবেই প্রকাশ পেতে দেওয়া হয় নি। বরং সমগ্র যুদ্ধ জুড়ে জার্মানদের বিভ্রান্ত রেখে তাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আগেই জানতো পারতো ব্রিটিশ ইন্টিলিজেন্স। ধারনা করা হয় এই কোড ব্রেকিং মিত্র শক্তির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল।


চিত্রঃ গণিতবিদ এলান ট্যুরিং ও তার যন্ত্র  

২। ফকল্যান্ড যুদ্ধ

ফকল্যান্ড যুদ্ধকে বলা যায় আধুনিক ইতিহাসে পুরোনো সাম্রাজ্যবাদের একটি ঝলক। আর্জেন্টিনার খুব কাছাকাছি অবস্থিত ফকল্যান্ড দ্বীপটির ব্রিটেন থেকে দূরত্ব প্রায় ৫,১৬৯ মাইল। এত দূরত্বে সফল একটি সামরিক অভিযান পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছে এমআইসিক্স এবং তাদের দেওয়া তথ্য।

 

৩। এফএসবি (FSB) 

সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবির নাম কে না শুনেছে। এমনকি রাশিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান ভ্লাদিমির পুতিনও সাবেক কেজিবি এজেন্ট। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যেমন রাশিয়া, কেজিবি থেকেও ঠিক তেমনি এফএসবি। 



পূর্ণ নাম 

ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস অফ রাশিয়ান ফেডারেশন (Federal Security Service of the Russian Federation - FSB)

স্থাপত্যকাল 

এপ্রিল ৩, ১৯৯৫ 

প্রধান কার্যালয় 

লুবায়াংকা বিল্ডিং, মস্কো, রাশিয়া 

মটো 

"Loyalty, Courage, Honor" ("Верность, Мужество, Честь")


ইতিহাস

কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি থেকে ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস। নাম পরিবর্তন হলেও ধরনের খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। তবে সাবেক কেজিবির দায়িত্ব সমূহকে অনেক গুলো ভাগ করে জন্ম নেয় ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা। এর ভেতর এফএসবি এর উপর ভার পরে জাতীয় নিরাপত্তা, কাউন্টার-ইন্টিলিজেন্স ও কাউন্টার-টেরোরিজম। 


চিত্রঃ কেজিবি এবং এফএসবি এর লগো 


গঠনতন্ত্র 

এফএসবি এর প্রধানকে বলা হয়ে থাকে ‘ডিরেক্টর’। তিনি সংসদীয় পদ্ধতিতে নয় বরং সরাসরি কাজ করেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির অধীনে। এফএসবি সরাসরি রিপোর্টও করে থাকে রাশিয়ান রাষ্ট্রপতির কাছে। তবে এফএসবির ইতিহাসে একজন ডিরেক্টরের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি স্বয়ং ভ্লাদিমির পুতিন! 


বিশেষত্ব 

কেজিবি এর ন্যায় এফএসবি এরও সবচেয়ে বড় শক্তি কাউন্টার-ইন্টিলিজেন্স। ভিন্ন দেশে এসপিওনেজ চালাতে তারা যতটুকু পারদর্শী, তার থেকে অনেক বেশী পারদর্শী নিজের দেশের তথ্য গোপন রাখতে। তবে এ গোপনীয়তা বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্থায়ীভাবে আর্কাইভ করে ফেলা হয়। 


এফএসবি এর আরেকটি বিশেষত্ব হলো জঙ্গী-বিরোধী অভিযান। এক্ষেত্রে এফএসবি অনেক ক্ষেত্রেই অমানবিক হিসেবে আখ্যায়িত। এর পাশাপাশি সংস্থাটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য ব্যাপক ভাবে সমালোচিত। 


প্রধান অপারেশনসমূহ 

১। চেচেন যুদ্ধ

প্রথম ও দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে চেচেনদের একটি বড় অংশ স্বাধীনতার প্রশ্নে লড়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার অসাধারণ গোয়েন্দা কার্যক্রমের মুখে তাদের হার মানতে হয়। এমনকি নৃশংস আক্রমণ চালানোর পরেও এ সংস্থার কল্যাণে চেচেনদের একটি বড় অংশ এখনও রাশিয়া পন্থী। 

২। লিতভিনেঙ্কো হত্যা

এসপিওনাজ জগতে বিশ্বাসঘাতকতা নতুন নয়।২০০০ সালে তেমনই এক এফএসবি এজেন্ট, আলেকজান্ডার লিতভিনেঙ্কো রাশিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যায়। কিন্তু এর প্রতিশোধ রাশিয়া নেয় ধীর ও স্থির গতিতে। ২০০৯ সালে লিতভিনেঙ্কো মারা যায় তেজষ্ক্রিয়জনিত অসুখে। তার শরীরে পাওয়া যায় দুর্লভ তেজষ্ক্রিয় পদার্থ পলিনিয়াম-২১০। এ ঘটনার জন্য ব্রিটিশ ইন্টিলিজেন্স বরাবরই রাশিয়াকেই দোষী করেছে। 

৩। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার

শুধুমাত্র দেশীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক ভাবেও নির্বাচন প্রভাবিত করার জন্য এফএসবির দুর্নাম রয়েছে। ফাঁস হওয়া বিভিন্ন ইমেইল থেকে ধারনা করা হয় যে, ২০১৬ সালের আমেরিকান নির্বাচনের উপরেও এফএসবির বেশ প্রভাব ছিল। 


৪। মোসাদ 

বাংলাদেশের মানুষ এমআইসিক্স, এফএসবির নাম নাই শুনতে পারে। কিন্তু যতটা শুনেছে সিআইএর নাম, ততটাই যেন শুনেছে মোসাদ এর নাম। শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতনের অন্যতম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে মোসাদ ঘৃণার পাত্রও হয়েছে। 


পূর্ণ নাম 

ইন্সটিটিউ ফর ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশন্স (HaMossad leModi'in uleTafkidim Meyuchadim - Institute for Intelligence and Special Operations)

স্থাপত্যকাল 

১৩ ডিসেম্বএ, ১৯৪৯ 

প্রধান কার্যালয় 

তেল আভিভ ইজরায়েল 

মটো 

"Where no counsel is, the people fall, but in the multitude of counselors there is safety" (Proverbs 11:14)


ইতিহাস 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রাপ্ত প্যালেস্টাইন বিলুপ্ত হয়। জন্ম হয় রাষ্ট্র ইজরায়েলের। ঠিক তার পরপরই ১৯৪৯ সালে জন্ম নেয় মোসাদ। মূলত সদ্য গঠিত রাষ্ট্রকে বিদেশী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতেই নেওয়া হয় এ পদক্ষেপ। এবং ইজরায়েল রাষ্ট্র চলার পদে পদে মোসাদ সেই দায়িত্ব ভালভাবেই পালন করেছে। তবে এ দায়িত্ব পালনের ভেতর মিশে ছিল আশে পাশের আরব দেশগুলোতে স্পাই নিয়োগ, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, গুপ্ত হত্যা ইত্যাদি। 

গঠনতন্ত্র 

মোসাদের প্রধানের পদবী হলো ‘ডিরেক্টর’। তিনি সরাসরি রিপোর্ট করেন ইজরায়েলের প্রধান মন্ত্রীর কাছে। মোসাদও সরাসরি প্রধান মন্ত্রীর অধীনেই পরিচালিত হয়। মোসাদকে মূলত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। হিব্রু ভাষায় এসকল বিভাগের নাম হলো, ‘জোমেত’ (Tzomet) , ‘কেশেত’ (Keshet), ‘চেসেরা’ (Caesarea), ‘তেভেল’ (Tevel), ও ‘নেভিয়ত’ (Neviot)। এই পাঁচটি বিভাগ যথাক্রমে স্পাই নিয়োগ, বিশেষ অপারেশন, গুপ্ত হত্যা, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় ও সাইবার ইন্টিলিজেন্স নিয়ে কাজ করে। 


চিত্রঃ মোসাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে নেতানিয়াহু 

বিশেষত্ব 

মোসাদের বিশেষত্ব যদি বলতে হয় তবে তা এর গুপ্তহত্যা এবং অপারেশনের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে অতিরিক্ত সাহসের পরিচয় দেওয়া। মূলত এই দুইটি জিনিস দিয়ে সংস্থা হিসেবে মোসাদের চরিত্রের কিছুটা ধারনা পাওয়া যায়। 


তবে পোষাকী ভাষায় বলতে গেলে মোসাদ কাউন্টার-টেরোরিজম তথা জঙ্গী-বিরোধী অভিযানে পারদর্শী। এখানে ‘জঙ্গী’ হিসেবে মোসাদ আখ্যায়িত করে প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন সংস্থাকে। প্যালেস্টাইনের নেতৃত্ব গোত্রীয় মানুষ থেকে শুরু করে, ভিন্ন দেশের একাডেমি থেকে পাশ করা সামরিক অফিসার, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী, সকলেই আছেন এই হত্যার তালিকায়। 


এছাড়াও প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গও মোসাদের গুপ্ত হত্যার শিকার হন। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেও ইরানের আণবিক বিজ্ঞানীরা। এসবের পাশাপাশি মোসাদ গোপনীয়তা রক্ষা, বিভিন্ন দেশে জিউদের স্বার্থ রক্ষা, ইত্যাদি কাজে ব্যাপক পারদর্শী। এছাড়াও ভিন্ন দেশে উদ্ধার কার্যক্রমে মোসাদ বিশেষ দক্ষ। 


প্রধান অপারেশনসমূহ 

১। অপারেশন এন্টাবি

১৯৭৬ সালে পরিচালিত অপারেশন এন্টাবি আধুনিক সামরিক ইতিহাসে অন্যতম সাহসী এবং নিখুঁত একটি রেসকিউ অপারেশন। প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দূরের উগান্ডা থেকে ১০০ এর বেশি ইজরায়েলী বন্দীকে উদ্ধার করে আনার সবচেয়ে বড় ক্রেডিট মোসাদ এবং ইজরায়েলী সায়রেত মাটকেল এর। 

২। অপারেশন সলোমান

এটিও ছিল ইজরায়েলের এক প্রকার উদ্ধার কার্যক্রম। ১৯৯১ ইথিওপিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে ইথিওপিয়ান জিউদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। পরবর্তীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে জিউদের চাপের মুখে পড়ে ইজরায়েল সরকার। ফলস্বরুপ মাত্র ৩৬ ঘন্টার ভেতর প্রায় ১৪,০০০ জিউকে প্লেনে করে ইথিওপিয়া থেকে ইজরায়েলে স্থানান্তর করা হয়। 


৫। এমএসএস (MSS) 

উপরের চারটি নামের পরে সবচেয়ে বেশি যেই গোয়েন্দা সংস্থাটির নাম শোনা যায়, সেটি ভারতের র’। অথবা পাকিস্তানের আইএসআই। কিন্তু কেউ কখনো ভেবে দেখেছে, পৃথিবীর বুকে রাশিয়াকে টপকিয়ে আমেরিকার সাথে পাল্লা টানা চীনের গোয়েন্দা সংস্থা আসলে কতটা শক্তিশালী? 


পূর্ণ নাম 

মিনিস্ট্রি অফ স্টেট সিকিউরিটি অফ দ্যা পিপল’স রিপাবলিক অফ চায়না (Ministry of State Security of the People's Republic of China - MSS)

স্থাপত্যকাল 

জুলাই ১, ১৯৮৩ 

প্রধান কার্যালয় 

বেইজিং, চায়না 


ইতিহাস 

এমএসএস যাত্রা শুরু হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল কার্যক্রমকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যে। তৎকালীন ‘সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট - সিআইডি’ (Central Investigation Department-CID) ও মিনিস্ট্রি অফ পাবলিক সিকিউরিটি (Ministry of Public Security), এই দুটোকে একত্রিত করে জন্ম নেয় এমএসএস। 


চিত্রঃ মিনিস্ট্রি অফ স্টেট সিকিউরিটি 

গঠনতন্ত্র 

যেহেতু এটি একটি মন্ত্রণালয়, তাই এটির প্রধান হলেন একজন মন্ত্রী। এই মন্ত্রী সরাসরি রিপোর্ট করেন ‘স্টেট কাউন্সিল অফ চায়না’ বরাবর। অর্থাৎ এমএসএস কোনো একক ব্যক্তি নয় বরং চীনের কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে চালিত। কাজের দিক থেকে একে সিআইএ (CIA) এবং এফবিআই (FBI) দুটোর একটি প্যাকেজ বলা হয় এটিকে।  


বিশেষত্ব 

এফএসবি এর মতই কাউন্টার-ইন্টিলিজেন্স এর দিক থেকে সেরা এমএসএস। চীনের অভ্যন্তরীণ তথ্য রক্ষার্থে এমএসএস খুবই কার্যকরী। ঠিক এজন্যই চীন কোনো কিছু তৈরি করে ফেলার আগ অবধি সেটির খোঁজ খুব কমই পাওয়া যায়। 

তবে এফএসবি এর সাথে এর আরও মিল রয়েছে। এমএসএস ও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বেশ হস্তক্ষেপ করে। এমনকি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ রক্ষা সরাসরি এদের দায়িত্বের মধ্যেই পরে। এসবের পাশাপাশি সাধারণ এসপিওনাজ পরিচালনাতেও এরা বিশেষ ভাবে পারদর্শী। 


প্রধান অপারেশনসমূহ 

১। অপারেশন ফক্স হান্ট

২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এই অপারেশন এখন অবধি চলমান। এই অপারেশনের অধীনে চীনের সকল অভিবাসী অপরাধীকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশে ফেরত আনতে অসমর্থ হলেও ভিন্ন পন্থা অবলম্বনেও দ্বিধা বোধ করে না সংস্থাটি। ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে এ অপারেশন খুবই সমালোচিত। 

২। সাইবার এসপিওনাজ

সাইবার আক্রমণের দিক থেকে চীন বরাবরই এগিয়ে। ২০১৫ সালে আমেরিকান কোম্পানি এন্থেম এর তথ্য চুরিতে সহায়তার জন্য চাইনীজ এমএসএসকে কঠোর ভাবে দোষারোপ করা হয়। যদিও প্রমাণিত নয়, তবে সে সময় প্রায় ৮০ মিলিয়ন গ্রাহকের তথ্য হটাৎ বেহাত হয়ে যায়। 

শেষকথা 

পরিশেষে এইটুকু বলা যায়, একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাফল্যের মাপকাঠি কখনই সংস্থাটির পরিচিতির মাত্রা নয়। বরং গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কাজই হলো লোকচক্ষুর অন্তরালে কার্য উদ্ধার করা। অর্থাৎ এ সকল গোয়েন্দা সংস্থার নাম অনেক বেশি শোনা হয় বা তাদের সেরা হিসেবে ধরা হয় ঠিকই। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরবে নিভৃত্বে লক্ষ্যে পৌছানোর ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের সংস্থা এগিয়ে থাকতেই পারে। আমরা যে তা জানি না বা সে নিয়ে কথা বলছি না, সেটিই তাদের সাফল্যের প্রমাণ।


Previous Post

Next Post

Related Posts

বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতের বিবর্তন: রক থেকে ফোক ফিউশন

18-09-2024

Miscellaneous

বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতের বিবর্তন: রক থেকে ফোক ফিউশন

বাংলাদেশের সঙ্গীতের বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা...

Read More
ভারতের সামরিক শক্তি আসলে কতটুকু?

17-09-2024

Miscellaneous

ভারতের সামরিক শক্তি আসলে কতটুকু?

প্রতিবেশী দেশ ভারত। দুই দেশের মানুষের মনোভাব যাই থাকুক...

Read More
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর ঠিক কি কাজ?

20-08-2024

Miscellaneous

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর ঠিক কি কাজ?

র’ - রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসি উইং। বাংলাদেশের গোয়েন্দা...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter