Home » MAWblog » International » গত ৩০ বছরে বাংলাদেশীদের ক্রমাগত দেশ ছাড়ার কারণ
International
Written by: এস এম নাহিয়ান
03-01-2024
বাংলাদেশীরা দেশ ছাড়ছে। গত ২০-৩০ বছরে এ চিত্র যেন নতুন কিছুই নয়। বরং দেশ ছাড়াটাই যেন হালের ফ্যাশন। ৫০-৬০ বছর আগে অভিবাসী হওয়াটা যতটা বড় ব্যাপার ছিল, এখন যেন ততটাই স্বাভাবিক। তবে এমন পরিবর্তন বিনা কারণে অথবা হঠাৎ করে হয় নি। সময়ের সাথে সাথে অসংখ্য কারণে বাংলাদেশীদের মধ্যে এসেছে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার মনোভাব। বিষয়টি শুধু যে আমরা আশে পাশে দেখে উপলব্ধি করছি তা নয়। বরং নানা ধরনের পরিসংখ্যানের ফলাফলও বলছে একই কথা। আজকের এই লেখায় তাই তেমনই কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, বাংলাদেশীদের দেশ ছাড়ার কারণগুলো আসলে কি কি।
খুব সহজ করে বললে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেয়ে বসবাস করাকেই বলে মাইগ্রেশন। যাকে সোজা বাংলায় বলে, দেশ ছাড়া। তবে এই মাইগ্রেশনের আবার দুইটি ধরন রয়েছে। ইন্টার্নাল মাইগ্রেশন (Internal Migration) ও এক্সটার্নাল মাইগ্রেশন (External Migration)। কোনো দেশের ভেতরেই এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যেয়ে বসবাস করলে, তাকে ইন্টার্নাল মাইগ্রেশন বলে। অপরদিকে কেউ যদি দেশত্যাগ করে, তবে সেটি এক্সটার্নাল মাইগ্রেশন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যা বা সুবিধা, যেটাই বলা হোক না কেন, এক্সটার্নাল মাইগ্রেশনই মুখ্য বিষয়।
দেশ ছাড়া নিয়ে কথা বলতে হলেই একটি দেশের নেট মাইগ্রেশন রেট নিয়ে কথা বলতে হয়। নেট মাইগ্রেশন রেট কথাটি মূলত আসে নেট মাইগ্রেশন থেকে। মূলত একটি দেশে এক বছরে যতজন ব্যক্তি এসে বসবাস শুরু করে এবং যতজন ব্যক্তি দেশ ছেড়ে চলে যায় তার বিয়োগফলই হলো নেট মাইগ্রেশন। যদি এক বছরে যত মানুষ চলে গিয়েছে তার চেয়ে বেশি মানুষ দেশে আসে, তাহলে নেট মাইগ্রেশন হয় পজিটিভ। অপর দিকে যদি মানুষ চলে যাওয়ার সংখ্যা মানুষ আসার সংখ্যা থেকে বেশি হয়ে থাকে, তাহলে নেট মাইগ্রেশন হয় নেগেটিভ।
নেট মাইগ্রেশনকে যদি একটি দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়, তবে যে সংখ্যাটি আসে সেটিই হলো নেট মাইগ্রেশন রেট। এর সাহায্যে জনসংখ্যার অনুপাতে কি পরিমাণ মানুষ দেশ ছাড়ছে / দেশে আসছে তা বোঝা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের নেট মাইগ্রেশন রেট দীর্ঘকাল ধরেই নেগেটিভ বা ঋণাত্নক।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা পরিচালিত পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে গত ৩০ বছরে বাংলাদেশীদের দেশ ছাড়ার বাস্তব চিত্র। এ সকল সংস্থার সংগ্রহকৃত তথ্য অনুসারে বাংলাদেশীরা যে দেশ ছাড়তে ইচ্ছুক, তা স্পষ্টতই বোঝা যায়।
পরিসংখ্যানের জন্য অন্যতম সংস্থা এই ম্যাক্রোট্রেন্ডস। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, ম্যাক্রো বা বৃহৎ ক্ষেত্রের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ তাদের। ইউনাইটেড নেশনস-ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রস্পেক্ট (United Nations-World Population Prospects) এর তথ্যের উপর ভিত্তি করে নিচের গ্রাফটির সৃষ্টি করেছে ম্যাক্রোট্রেন্ডস।
উপরের ছবিটিতে রয়েছে দুইটি উপাত্ত। উপরের নীল গ্রাফটির মাধ্যমে সহজেই বোঝা যাচ্ছে ১৯৯৩ থেকে ২০২৩ অবধি বাংলাদেশের নেট মাইগ্রেশন রেটের অবস্থান। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মাইগ্রেশন রেট ছিল ২০০৮ সালে, যা ছিল -৪.৫৪২। অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জনে সাড়ে চার জন বাংলাদেশী দেশ ত্যাগ করেছিলো। পরবর্তীতে অবশ্য এই হার কমে এসেছে। গত চার বছর ধরেই নেট মাইগ্রেশন রেট ২% এর কিছুটা বেশি হারে কমছে। অর্থাৎ দেশ ছাড়ার পরিমাণ সামান্য হলেও কমছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের নেট মাইগ্রেশন রেট ছিল -২.০৬৫। অর্থাৎ ২০২২ সালে হাজারে ২ জনের বেশি মানুষ দেশ ত্যাগ করছিল।
নিচের গ্রাফটির মাধ্যমে প্রতিবছর নেটমাইগ্রেশন রেট কিরুপ পরিবর্তন হয়েছে তা বোঝানো হচ্ছে।
তথ্য উপাত্তের জন্য আরেকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র হলো বিশ্ব ব্যাংক। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত ৩০ বছরে একবারও বাংলাদেশের নেট মাইগ্রেশন পজিটিভ ছিল না। অর্থাৎ গত ৩০ বছরের প্রতিটি বছরেই বাংলাদেশে লোক আসার তুলনায় লোক যাওয়ার সংখ্যাটা বেশি।
ওয়ার্ড ব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ নেট মাইগ্রেশন ২০০৮ সালে, ১৩,৯০,৭৮২ জন। অর্থাৎ ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আগমন করা মানুষের সংখ্যা ও প্রস্থান করা মানুষের সংখ্যার পার্থক্যটা ১৩,৯০,৭৮২ জন। এই চার্টটি ম্যাক্রোট্রেন্ডস এর নেট মাইগ্রেশন রেটের উপাত্তের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্বখ্যাত দুইটি সংস্থার এই উপাত্ত ও গ্রাফগুলোই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশীদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার হার আসলে কতটা ব্যাপক।
বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার হার বাংলাদেশীদের মধ্যে যে ব্যাপক, সে নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু ঘুরে ফিরে একটি প্রশ্নই ওঠে, এত বিপুল পরিমাণ মানুষের দেশত্যাগের পেছনে কারণটা কি? এর উত্তর খুঁজতে গেলে মেলে বেশ কঠিন ও বাস্তব কিছু কারণ।
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। স্বভাবতই এ দেশের শ্রম বাজার অধিকাংশ দেশের তুলনায় সস্তা। তাই যোগ্যতা সম্পন্ন একজন ব্যক্তির যেই পারিশ্রমিক পাওয়া উচিত, তা অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিত হয় না। কারণ বিশাল জনসংখ্যা থাকায়, কিছুটা কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি দিয়েও অনেক কম পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নিতেই অনেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ক্রমাগত এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ায় অনেকেই এ দেশে জীবিকা নির্বাহের আগ্রহ হারিয়েছেন। এর বাইরেও বিশেষায়িত কাজের সুযোগ এ দেশে কম হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পেশার অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এছাড়াও নানা ধরনের দুর্নীতির কারণে অনেক শিক্ষিত জনশক্তিই তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পান না। সব মিলিয়ে দেশের জনশক্তির বড় একটি অংশ নিতান্ত হতাশ হয়েই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
অনেকের কাছেই তার ও তার পরিবারের জন্য জীবনযাত্রার মান অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বসবাসের অযোগ্য শহর গুলোর তালিকায় ঢাকা প্রথম দিকে থাকায় সামর্থ্যবান অনেকেই দেশে থাকতে চান না। এমনকি দেশে পর্যাপ্ত অর্থ-বিত্ত ও সম্মান থাকলেও অনেকে শুধু জনজীবনের নিরাপত্তার খাতিরে বিদেশে পাড়ি জমান।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই নাজুক হওয়ায় যারা বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চান, তারা সকলেই বিদেশের মুখাপেক্ষী হন। তবে বর্তমানে এই কারণটির সাথে মিশে গেছে প্রথম দুইটি কারণ। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পাওয়া এবং মানবেতর জীবন যাপন করা অনেক ছাত্র-ছাত্রীকেই বাধ্য করে বিদেশে পাড়ি জমাতে। শুধু মাত্র শিক্ষার উদ্দেশ্যে অনেকে পাড়ি জমান বটে, কিন্তু সিঙ্ঘভাগই এখন একটি ভাল জীবনযাত্রার মান উপভোগ করতে উচ্চশিক্ষার উছিলায় বিদেশে গমন করেন।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বর্তমানে অফিসারশ্রেণীর না হলে অনেকের কাছেই সম্মান পাওয়া যায় না। অথচ বিদেশে মালির কাজ থেকে শুরু করে মিস্ত্রীর কাজ, সকল কাজকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমনকি বিদেশী অধিকাংশ দেশেই এ ধরনের কাজেই আয় অনেক বেশি হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর জনশক্তির একটির বড় অংশ স্কুল পার হওয়ার পর এসব কাজেই দক্ষ হয়ে ওঠে। অথচ সেসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের স্নাতক পাশের সংখ্যা বহু গুনে বেশি। কিন্তু দক্ষতাবিহীন ডিগ্রির মূল্য খুব কমই পাওয়া যায়। অপর দিকে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থায় মালি, মিস্ত্রি, ড্রাইভার ইত্যাদি কাজকে কিছুটা নিচু শ্রেণীর হিসেবে দেখা হয়। ফলে অনেকে চাইলেও এসব কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না। কিন্তু বিদেশে এমন মনোভাব না থাকায় অনেকেই এসব কাজ করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সমাজের চালিকাশক্তি এখন অর্থ। তাই বেশি আয়ের সুযোগ অনেক বাংলাদেশী নাগরিককেই বিদেশে নিয়ে আসে। এর অন্যতম কারণ হলো দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মুদ্রা অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ায় সেখানের অল্প উপার্জনই বাংলাদেশের বিপুল উপার্জন। আর ঠিক সেজন্যই এদেশের অনেক মানুষ আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম, ইতালী ও বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে পাড়ি জমিয়ে থাকে।
এই কারণটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও বাংলাদেশী নারীদের দেশ ছাড়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় এখনও নারীদের অবস্থান কিছুটা পিছিয়ে। তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক নারীই এমন সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তি চান। অথবা অনেকেই স্বামী-সন্তানের সাথে বিদেশ গমনের পর আর ফেরত আসতে ইচ্ছুক হন না। বিষয়টি উপরের কারণগুলোর ন্যায় বৃহৎ না হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ বটে।
পরিশেষে এইটুকু বলা যায়, প্রতিটি দেশের ভাল খারাপ দিক রয়েছে। দেশের খারাপ দিকগুলোকে পাশ কাটিয়ে শুধু ভাল দিক গ্রহণের মানসিকতা থাকলে দেশের উন্নতি কখনই সম্ভব নয়। আবার ঠিক একই ভাবে, একজন মানুষের পূর্ণ অধিকার রয়েছে নিজের কর্ম, বাসস্থান পছন্দ করার। একই সাথে স্বাধীনতা রয়েছে নিজের জীবনযাত্রার অধিকতর মান নিশ্চিত করার। বিশেষত অনেক বাংলাদেশীই বাংলাদেশের যথাযথ মূল্যায়ন না পেয়ে অবশেষে বাধ্য হয়েই বিদেশে পাড়ি জমান। এমতাবস্থায় কোনো এক পক্ষের সমর্থনে ঢালাও ভাবে কথা বলার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের দেশ ত্যাগের সবচেয়ে বড় কারণগুলো খুঁজে বের করার মাধ্যমে সার্বিক পদক্ষেপ নেওয়াই হতে পারে সবচেয়ে বড় সমাধান। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এ দেশের মানুষদেরই স্বদিচ্ছা, সে কথা বলাই বাহুল্য।
১। ম্যাক্রোট্রেন্ডস (Macro Trends)
২। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক (World Bank)
৪। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্লোসারি (World Bank Glossary)
৫। দ্যা ডেইলি স্টার (The Daily Star)
৬। সিপিডি (CPD)
06-11-2024
International
মার্ক জাকারবার্গ, যিনি প্রযুক্তি জগতে ফেসবুক প্রতিষ্ঠা...
Read More05-11-2024
International
বাংলাদেশের ই-কমার্স এবং অনলাইন মার্কেটিংয়ের জগতে নতুন...
Read More04-11-2024
International
বাংলাদেশ ও ভারত—দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক...
Read MoreTop 10 in...
03-10-2022
Miscellaneous...
20-08-2024
Miscellaneous...
10-12-2023
International...
03-10-2024
MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.
We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.