বাংলাদেশে প্রবেশ করা আন্তর্জাতিক নদী আর তার উপর বাঁধ, এ সকল বাঁধের প্রায় প্রতিটি ভারতের তৈরি। আন্তর্জাতিক নদীতে প্রত্যেক দেশের যে সম অধিকার, তাকে সম্পূর্ণ বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর ভেতর ৩০টিতেই বাঁধ দিয়েছে ভারত। এতে করে প্রতিবছর বাংলাদেশ হচ্ছে ভয়াবহ বন্যার শিকার। এ প্রেক্ষিতে এদেশের অসংখ্য মানুষের মনে একটিই চিন্তা, ভারতের ন্যায় বাংলাদেশও কি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না?
৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর ভেতর ৩০টিতেই বাঁধ দিয়েছে ভারত। এতে কমেছে নদীর নাব্যতা, হঠাৎ পানির চাপে উপচে পড়ছে দুই পাড়। এমতাবস্থায় দেশের পূর্বাঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, লক্ষীপুর, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, ইত্যাদি জেলা গুলো ভয়াবহ বন্যার শিকার।
ভারতের পদ্মা নদী গঙ্গা হিসেবেই পরিচিত। আর এই গঙ্গা নদীর অববাহিকায় বিভিন্ন ছোট ছোট শাখা নদীর উপরে ভারতের ড্যাম রয়েছে ৭৯৫টি। সংখ্যাটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও ‘ইন্ডিয়া ওয়াটার রিসোর্স ইনফরমেশন সিস্টেম’ এর ওয়েবসাইটে প্রতিটি ড্যামের অবস্থান সহ দেওয়া আছে।
পদ্মায় নির্মিত সবচেয়ে বড় দুইটি বাঁধের একটি হলো ‘ভিমগোদা ব্যারেজ’। হরিদ্বারের এই ব্যারেজের সাহায্যে হিমালয় থেকে বাহিত অধিকাংশ পানি এর আশে পাশের অঞ্চলের সেচের কাজে লাগানো হয়। পদ্মার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বাঁধটি আমরা সবাই চিনি। সেটি হলো ফারাক্কা ব্যারেজ। মূলত পদ্মার পানি হুগলি নদীতে নিয়ে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখাই এই ব্যারেজের মূল লক্ষ্য।
প্রত্যেক নদীরই পানি পরিবহন করার একটি ধারনক্ষমতা থাকে। নদীর স্রোতের সাথে ভেসে আসে পলিমাটি। কিন্তু নদীতে যদি স্রোতই না থাকে, তাহলে সেই পলিমাটির ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি নদীর থাকে না। ফলে খুব দ্রুতই নাব্যতা হারায় নদী। ফলাফলঃ নদীর মৃত্যু। তেমনটাই ঘটেছে বাংলাদেশের অসংখ্য নদীর সাথে।
নাব্যতা হারিয়ে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের ক্ষমতাই নেই অধিকাংশ নদীর। ফলে অতিবৃষ্টি এবং বন্যার সময় ভারত থেকে আসা অতিরিক্ত পানির চাপ কোনো ভাবেই নেওয়া সম্ভব হয় না নদী গুলোর পক্ষে। ফলস্বরুপ, বন্যা। বর্তমানে দেশের পূর্বাঞ্চলে এমন বন্যা দেখা দিলেও, দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা গুলো তিস্তার পানিতে তলিয়ে যাওয়া প্রায় নিয়মিত চিত্র। আর সেখানেও কারণটি একই। ভারতের একের পর এক বাঁধের কারণে বাংলাদেশ অংশে এসে তিস্তা মৃত। ফলে বন্যার সময় হঠাৎ করে ব্যারেজ খুলে দিলে সে পানি সামলানোর কোনো সক্ষমতাই থাকে না এসব নদীর।
ভৌগলিক ভাবেই বাংলাদেশের উচ্চতা বেশ কিছুটা কম। এদেশকে বৃহত্তম বদ্বীপ বলা হয়। কারণ যুগে যুগে বিভিন্ন নদীর অববাহিকা থেকে আসা পলিমাটি দিয়েই এ অঞ্চল গঠিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের জমি যেমন খুবই উর্বর, অন্য দিকে উচ্চতাও অনেক কম। তরল পদার্থ বা পানির ধর্মই হলো তা ঢালুর দিকে প্রবাহিত হয়। তাই নিচু উচ্চতার দেশ হয়ে কখনোই বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা সম্ভব না। কারণ বাঁধ দিলে পানি বিপরীত দিকে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে বন্যার ক্ষেত্রে বাঁধ ভেঙে আরও প্রয়ংকারী বন্যা হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।
ইন্টারন্যাশনাল ল অফ রিভার রিসোর্সেস একটি আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা যা জাতীয় সীমানা অতিক্রমকারী নদী এবং তাদের সংযুক্ত ভূগর্ভস্থ জল কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তা নিয়ন্ত্রন করে, 1966 সালের আগস্টে ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশন (ILA) দ্বারা গৃহীত হয়।
এই ঘোষণা অনুযায়ী, কোনো আন্তর্জাতিক নদীর গতিপথ শুধুমাত্র একটি দেশ দ্বারা পরিবর্তন করা যায় না। এই ঘোষণা নির্দেশ করে যে, আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কে এমন আইন বহু বছর ধরেই চলমান। এসব আন্তর্জাতিক আইনের বাইরেও, মন্টেভিডিও ঘোষণা, ১৯৩৩ এর ধারা ২ এবং হেলসিংকি রুলস, ১৯৯৬, ধারা ৪ অনুযায়ী অন্য দেশের মতামত নিয়ে আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধা সৃষ্টি করার অধিকার কোনো রাষ্ট্রের নেই।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভায় এই আইনটি গৃহীত হয়। এই কনভেনশনের আর্টিকেল ৫ অনুযায়ী, সমান ও যৌক্তিক ভাবে একটি আন্তর্জাতিক নদীর পানি বন্টন করতে হবে। এই কনভেনশনটি ১৯৯৭ সালে গৃহীত হওয়ার পরে জাতিসঙ্ঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রেরই এই আইনটি মানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ভারত এই আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন করেছে।